প্রকাশকের কথা
‘অক্ষর’ হচ্ছে সভ্যতা এবং জ্ঞানের ধারক ও বাহক। অক্ষরের মাধ্যমেই সভ্যতা এবং বিজ্ঞান ধাপে ধাপে উন্নতি সাধন করে। অক্ষর-ই মানুষকে পার্থিব এবং অপার্থিব জ্ঞানে পরিপূর্ন আলোকিত করার পথে সুমহান ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই মানব সভ্যতার চরম শিখরে পরিপূর্ণ জীবন বিকাশের লক্ষ্যে আর্ভিভূত, সকল নবী-রাসূলের নূরের মূল উৎস, অনন্ত ব্রহ্মান্ডের মহা আলোকবর্তিকা হযরত মোহাম্মদ মুস্তফা (সা.) ‘নিরক্ষর’ হবেন এটা আশেকে রাসূলগন কখনোই মেনে নিতে পারেনি।
কোরআন-হাদিসের অকাট্য দলিল সম্বলিত ‘নাবিউল উম্মি’ পুস্তকটি সেই অমানিশা বিদুরিত করে রাসূলে পাক সম্পর্কে শত শত বৎসর ধরে চলে আসা একটি মহা মিথ্যাকে ভেঙ্গে-চূরে গুড়িয়ে দিয়েছে। ‘নাবিউল উম্মি’ নিয়ে শত শত বৎসরে বাংলা ভাষায় তেমন কোন পুস্তক লেখা হয়নি। মহাত্মা রফিক শাহ্ অত্যন্ত দক্ষ্যতার সাথে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন যে, রাসূলে পাক (সা.) নিঃসন্দেহে লিখতে এবং পড়তে পারতেন; কারণ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই ছিলেন তাঁর মহান শিক্ষক। আর এই কথা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন সূরা ৯৬ আলাকের ০৪ নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন-
ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ
“আমি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়াছি।”
‘নাবিউল উম্মি’ বইটির দ্বিতীয় প্রকাশনার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই খুবই আনন্দিত এবং গর্বিত। আশা রাখি আশেকে রাসূলগন বইটি পড়ে ‘নাবিউল উম্মি’ সর্ম্পকে সকল সংশয় কাটিয়ে প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবেন।
– প্রকাশক
আলে রাসূল পাবলিকেশন্স
গ্রন্থকারের সংক্ষিপ্ত জীবনী
গত শতকের আশি এবং নব্বইয়ের দশকে মির্জাপুর এবং কালিয়াকৈর উপজেলায় ওহাবী, খারেজী, সালাফী এবং লা-মাজহাবীদের তৎপরতা খুবই বেড়ে যায়। প্রকৃত মোহাম্মদী ইসলামের আলো নিস্প্রভ হয়ে আসছিল। দৃশ্যমান ইসলাম ধর্ম বাতিল আকিদায় পরিপূর্ন হয়ে উঠছিল। বহু ওহাবী খারেজী, সালাফী এবং লা-মাজহাবী পন্ডিতগণ মওলানা আব্দুল হাই সালাফীর নেতৃত্বে আশেকে মোহাম্মদ তথা আশেকে আহলে বাইতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। তারা মিলাদ-কিয়াম, এলমে মারিফাত, এলমে তরিকত তথা পীর-মুরীদির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ এবং মাইকিং শুরু করে।
তখন অত্র অঞ্চলের পীরগন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলে তরিকতপন্থী সাধারন মানুষ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। তারা বাতিলপন্থী মওলানাদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন।
এ সময়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে কাদরীয়া তরিকার একজন বিপ্লবী পীর এগিয়ে আসেন আর তিনিই হচ্ছেন অত্র অঞ্চলের কুতুব শাহ সূফী হযরত রফিক শাহ্ আল হাসান আল কাদ্রী। তিনি কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে জুম্মার নামাজের পর মওলানা আব্দুল হাই সালাফী সহ আরও অনেক মওলানা, মুফতিদের সাথে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে বাহাস করেন। তাঁর কোরআন-হাদিস ভিত্তিক অকাট্য দলিল এবং তাঁর জালালিয়াত অবলোকন করে মওলানা আব্দুল হাই সাল্ফাী বলেছিলেন- “আপনি-ই হক্কানী পীর আর যারা আমার সামনে আসতে পারে নাই তারা ভন্ড পীর।” এরুপ চল্লিশটিরও অধিক বাহাস করেছেন তিনি এবং বিজয়ী হয়েছেন প্রতেকটিতে কারন তিনি দুই/তিন শত কিতাব নিয়ে বাহাস করতেন। কখনো কখনো থানা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতেও বাহাস হতো।
এজন্য বাতিলপন্থীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তাঁর ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল কিন্তু তাকে কেউ দমাতে পারেনি।
এভাবেই পবিত্র আহলে বাইতের মোহাম্মদী ইসলামী ধারাকে অত্র অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করতে সারা জীবন সিংহের মত লড়াই করেছেন। ভন্ড পীর এবং ওহাবী পীরদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
তিনি সাধারন মানুষের আত্মিক জাগরণের জন্য পবিত্র আহলের বাইতের প্রতি প্রেম, মিলাদ-কিয়ামের গুরুত্ব, কারবালার প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে লিফলেট বিতরণ করে সাধারন মানুষের সংশয় দূর করতেন এবং বাতিলপন্থীদের ‘এজিদী ইসলাম’ প্রচারনাকে স্তব্ধ করে দিতেন।
তিনি সাগর সামস্ কর্তৃক সম্পাদিত সুরেশ্বর দরবারের ‘তাওহিদী নূর’সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।
এছাড়াও তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন মরমী কবি। তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচ শতাধিক আধ্যাত্বিক গান রচনা করেছেন, যে গানগুলির সুর দিয়েছেন তিনি নিজেই। তার গানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ঘোর অমানিশা থেকে মানব আত্মার মুক্তির সন্ধান অন্বেষণ করা। কোরআন-হাদিসের গভীর তত্ত্ব জ্ঞানী এই কামেলে মোকাম্মেল বেশ কয়েকটি কিতাবও লিখেছেন। যেমন-
১) মুক্তির সন্ধান ১ম ও ২য় খন্ড
২) সৃষ্টি দর্শনে তিনের রহস্য
৩) তরিকত দর্শন
৪) জিহাদ
৫) গান বাজনার রহস্য
৬) সমাধানে হাকিকত
গাউসে পাক বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.)-এর বংশধর হয়েও তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ। তিনি কোদালীয়া জামে মসজিদে দীর্ঘ বিশ বৎসর ঈদের জামাতের ইমামতি করেছেন। গোড়াই অঞ্চলের অনেকেই তার নিকট কোরআন পড়া শিখেছেন এবং কোরানের জ্ঞান লাভ করেছেন। তিনি মাত্র দু-বেলা আহার করতেন এবং সদা-সর্বদা খড়ম পরিধান করতেন। অনেক ওলী-আউলিয়ার সাথে তার গভীর সুসর্ম্পক ছিল।
এই মহাত্মা ১৯৯৮ সালের ৩১শে আগষ্ঠ, সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে দশটায় পরিবারের সকলকে ডেকে, সকলের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে সিজদারত অবস্থায় পরলোক গমন করেন। তার পিতা এবং মোর্শেদ কুতুবুল আখতাব শাহ্ সূফী হযরত বাছেদ শাহ্ আল হাসান আল কাদরীর রওজার পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। অত্র অঞ্চলে তাঁর হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ রয়েছেন।
মুখ বন্ধ
এমন কোন বিদ্যাবত্তা আমি নই, যাহা দ্বারা কোন গ্রন্থ রচনা করিতে পারি। কোন বিচিত্র অভিজ্ঞতাও নেই, যাহা দ্বারা নতুন পথের সন্ধান প্রদান করিতে পারি। বিশেষ কোন জ্ঞানের আলোও আমার মাঝে নেই, যাহা দ্বারা সত্য পথিকের পথকে আলোকিত করিতে পারি। অনাবিল প্রান বোধনীয় ভাবাবেগের উৎস কোথায় তাহাও আমার জানা নেই।
তবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, পরিচালনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল ইজ্জতের যে মহা কুদরতি শক্তির প্রয়াস, সেই মহা কুদরতি শক্তির একাংশ, “ইয়া ওয়াছেউ” অর্থ: বিস্তারকারী, বিকাশকারী বা প্রকাশকারী। এই পবিত্র নামের বা শক্তির জ্যোতি বিকিরণ ঘটাইয়া আমা হইতে তাঁর নিজের ভাব প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়াই আমার বিশ্বাস। যেমন বাশরী তাঁর বাঁশীতে ফুকিয়া নিজের ভাব প্রকাশ করিয়া থাকে।
সে মতে আমার প্রচেষ্টা অকিঞ্চিতকর হইলেও দোষনীয় হইবে না; বরং কিঞ্চিৎ হইলেও সৃষ্টির মূল সত্তা সম্বলীত জ্ঞান বিকাশে আতœশক্তি পরমাত্মিক গুনের সংস্পর্শে ধমীয় চেতনার কিঞ্ঝিৎ দিক নির্দেশনা লাভ হইতে পারে বলিয়া আমার আন্তরিক ধারণা।
এক্ষণে সূধি পাঠক পাঠিকার করকমলে এই গ্রন্থটি তুলিয়া দিলাম। আদরনীয় হইলে শ্রমকে সার্থক মনে করিব। গ্রন্থের যাবতীয় ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আবেদন রইলো। সকল প্রকার গুন ও কুদরতি শক্তির সার্বিক মালিক একমাত্র আল্লাহ পাক। তাই সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য, তিনিই একক প্রশংসার একমাত্র হকদার।
আর সকল প্রকার নিন্দাবাদের শ্রেষ্ঠ হকদার আমি ।
– রফিক শাহ্