বাংলা অনুবাদকের কথা:
পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য, এবং সালাত ও সালাম নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতি, যিনি আম্বিয়া ও মুরসালিনদের ইমাম, আমাদের অধীশ্বর আবি আল-কাসিম মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের প্রতি। এবং আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক তাঁর উপর ও তাঁর উত্তরসূরী, পথপ্রদর্শক এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত বারোজন ইমাম (আ)-এর উপর।
“নাহজ আল-ফাসাহাহ” অর্থাৎ বক্তৃতাদাননিদ্যা বা অলঙ্কারশাস্ত্রের ঊর্ধবিন্দু বা উচ্চততর মহিমাপূর্ণ বাণীর শিরোনামের অতি মহিমাম্বিত ও বিখ্যাত বইটি ইসলামের মহানবী (সা)-এর বিশুদ্ধ ও বাগ্মী ভাষায় প্রাজ্ঞ বাণীর এক অতুলনীয় ভান্ডার। বইটি ১৯৫৭ সালে প্রয়াত আবুল গাসিম পায়ন্দে প্রথম চয়িত করেন। তখন থেকে মানুষের জীবনের কন্টকময় পথ পরিস্কার ও সুন্দর করার জন্য মহানবী (সা)-এর জ্ঞানের জলাধিপা থেকে নির্দেশনা লাভ করে সাধারণ মানুষ এবং শ্রেষ্ঠগুণসম্পূন্ন ব্যক্তিবর্গ উভয়ই ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়ে আসছে।
আমি যখন আমিরুল মুমিনীন আলী (আ)-এর গুরারুল হিকাম বইটি অনুবাদের কাজ শুরু করি তখন এই বইটি আমার দৃষ্টিতে আসে, এবং আমার চিত্ত ও আত্মা সেটির প্রতি প্রণত হয়। আর আমার জানা মতে পুরো বইটি বাংলায় অনুবাদ হয়নি তখনই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে গুরারুল হিকাম বইটির কাজ শেষ করার পর আমি নাহজুল ফাসাহা বইটি বাংলা ভাষী পাঠকদের উপহার দেবো। কারণ ইংরেজি অনুবাদকের ভাষ্য অনুযায় মহানবী (সা)-এর বাণীর যত কিতাব সংকলিত বা রচিত হয়েছে তা নির্দিষ্ট কোন উৎস হতে, কিন্তু নাহজুল ফাসাহা বইটি এমন একটি হাদিস গ্রন্হ যা সকল ইসলামী মাজহাবের কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত রাসুলুল্লাহ (সা)-এর অমিয় বাণীর সংকলন।
অর্থাৎ নাহজুল ফাসাহা এমন একটি হাদিসের কিতাব যার হাদিস গুলো শী’য়া ও সুন্নী উভয় উৎসে নথিভুক্ত হয়েছে। ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করতে আমি যতদূর পেরেছে অবিকল তথা সঠিক অনুবাদ করার চেষ্টা করছি। যেখানেই সম্ভব, মূল বক্তব্যের সংক্ষিপ্ততা, বাগ্মীতা এবং পাঠের উজ্জ্বল নান্দনিক উপাদানগুলো অক্ষত রাখা হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের একাধিক বাংলা অর্থ হতে যতটা সম্ভব সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ও যথাযথটি নির্বাচন করেছি। কিন্তু একটা জিনিস আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে একটা ভাষা থেকে আরেকটি ভাষায় অনুবাদ হৃদয়ঙ্গম বা উপলব্ধির বিষয়। সুতরাং আমার অনুবাদকে আমি কোনোভাবেই মহানবী (সা)-এর অত্যন্ত বাগ্মী ও গভীর অর্থপূর্ণ বাণীর নিখুঁত অনুবাদ দাবি করি না। এটি কেবলমাত্র হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পবিত্র স্বর্গীয় জিভের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে যা প্রকাশ করা হয়েছিল তার প্রতিফলন করে।
হে সাহেব আল আমর (আ ফ শ), আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক, আমি আপনার নেক নজর কামনা করছি, আর অনুগ্রহ করে আমাকে কখনোই পরিত্যাগ করবেন না।
মোঃ তুরাব রসুল।
২৬ শে জানুয়ারি ২০২৪, ১৩ ই রজব, ১৪৪৫ হিজরি
পরিচিতি ও নামকরণঃ
নাহজ আল-ফাসাহা: অর্থাৎ কালামাত-ই-কেসার-ই-হাযরত-ই-রাসুল(সা) অর্থাৎ ‘নবী করিম (সা)-এর নীতিবচন বা সারগর্ভবাক্য’ (বক্তৃতাদাননিদ্যা ও বাগ্মীতা তথা আড়ম্বরপূর্ণ ভাষার উচ্চতা বা মহিমা) এটি হলো নীতিশাস্ত্র (নৈতিকতা, সততা, ধার্মিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, সুনীতি) এবং সদগুণ সংত্রুান্ত বিষয়ে নবী মুহাম্মাদ (সা) হতে বর্ণিত অলঙ্কারপূর্ণ বাণীসমূহ। যা আবুল গাসিম পায়ান্দেহ সংকলিত একটি হাদিস গ্রন্হ। বইটির নামকরণ মহানবী (সা) এর একটি হাদিসের আলোকে নাহজ আল-ফাসাহা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) হতে বর্ণিত হাদিস খানা হলো “আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বাগ্মী।”
বিষয়:
লেখক আবুল গাসিম পায়েন্দেহ এই গ্রন্হে মহানবী (সা) হতে ফযীলত এবং আখলাক সম্পর্কীত বাণীগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ফিকহ ও অন্যান্য হাদিসগুলো এড়িয়ে গেছেন। বইটির বিষয় এবং এর সঠিকতা সম্পর্কে, লেখক বলেছেন: “আমি বছরের পর বছর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে মূল পাঠ্য সমূহ অধ্যয়ন করে রাসুলুল্লাহ (সা)-এর বাণীর সংকলনটি রচনা করেছি এবং যতটা সম্ভব আমার জীবন এটিতে ব্যয় করেছি। তবে এতে আমার সমস্ত মনোযোগ দাওয়ার পরও যদি এতে কোনও ভুল হাদিস থাকে, আমি চিন্তিত না কারণ আমি নবী করিম (সা)-এর প্রতি কোন ভুল বর্ণনাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে সম্পৃক্ত করিনি বা অন্যদের থেকে কোন দুর্বল বক্তব্য উদ্ধৃত করিনি। এরপরও আমার (ভুলকে) মানিয়া নেয়া যেতে পারে কারণ এই সঙ্কলনটি হালাল এবং হারাম সম্পর্কে নয়। এটা সততা, সৎ গুণাবলী এবং আত্মিক পরিপূর্ণতা সম্পর্কীত হাদিস, এবং অতীতের হাদিস বিশারদগণ সবসময় এই ধরনের হাদীসের বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদের বিষয়ে সহজ তথা নমনীয় ছিলেন।”(৪)
এই সঙ্কলনের কিছু বাণী ইমাম আলী (আ) এর সাথে সম্পর্কীত করা হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলোর অর্থ ও শব্দ একই রকম। রেফারেন্সের এই ধরনের অস্পষ্টতা বা অনির্দিষ্টতা সম্পর্কে, লেখক বলেছেন, “অনেক ঘটনা আছে, যখন ইমাম আলী (আ) সম্পর্কিত অনুরূপ উক্তি এবং প্রতিবেদনগুলো নবী করিম (সা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যা কেউ কেউ মনে করেন যে এটি বর্ণনাকারীদের ভুলের কারণে হয়েছে। যাইহোক, এমন ঘটনার বাস্তবতা হলো যে হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং ইমাম আলী (আ)-এর মধ্যে আধ্যাত্মিক মিল থাকার ফলাফলের কারণ।
নাহজ আল-ফাসাহাহ-বর্ণিত কয়েকটি হদিস:
“একজন (প্রকৃত) মুমিন মানুষকে উপহাস, অভিশাপ, অপবাদ এবং গালি দেয় না।”
“একজন মুমিন চালনির মতো, যে পরিষ্কার ছাড়া কিছুই গ্রহণ করে না এবং বিশুদ্ধ ছাড়া কিছুই নির্গত (বাহির করা) করে না।”
“এই (ধর্মনিরপেক্ষ, আত্মবাদী, অহংবাদী) জগৎ থেকে একজন মুমিনের প্রস্থান হলো মাতৃগর্ভ থেকে একটি শিশুর মুক্তির মতো, অন্ধকার ও দুর্দশাকে ছেড়ে সুবৃহৎ ভূভাগের স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রসারণের দিকে।”
“হে লোকসকল, আমি তো একজন মানুষ, শীঘ্রই আমার প্রভুর রাসুল আসবেন এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের কাছে দুটি মহান জিনিস রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত, প্রথমটি রয়েছে হেদায়েত ও জ্যোতি। যে এটাকে দৃঢ়মুষ্টিতে আকড়ে ধরবে ও সমাদর করবে সে হেদায়েত পাবে এবং যে তা উপেক্ষা করবে সে পথভ্রষ্ট হবে। সুতরাং, মহান আল্লাহর কিতাব আঁকড়ে ধর এবং এর মর্ম উপলব্ধি করার (চেষ্টা কর)। পরেরটির জন্য, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি! আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি!”
“হে আল্লাহ! নেত্রজল (অশ্রু) রক্তে ও দাঁত অনলে (আগুন) পরিণত হওয়ার পূর্বে তোমার ভয়ে ঝরে পড়া অশ্রুজল দ্বারা আমার হৃদয়কে দোষমুক্ত করার জন্য আমাকে দুটি অশ্রুসিক্ত নয়ন দাও।”
“বল, হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে এমন একটি পরিতৃপ্ত আত্মা (নাফসে মুতমাইন) চাই যে তোমার সাক্ষাতে বিশ্বাসী, তোমার পূর্বনির্ধারণে (ক্বাযা) সন্তুষ্ট এবং তোমার দানে তৃপ্ত হয়।”
“জ্ঞান অন্বেষণ করা সকল মুসলমানের জন্য ফরয এবং যে ব্যক্তি তার জ্ঞান অযোগ্য (অপদার্থ) লোকদের কাছে প্রকাশ করে সে সেই ব্যক্তির মত যে শুয়োরকে রত্ন, মুক্তা এবং স্বর্ণ দিয়ে সাজায়।”
“জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। এবং যে জ্ঞান অন্বেষণ করে তার জন্য সকলে (সবকিছু) ক্ষমা প্রার্থনা করে, এমনকি সমুদ্রের তিমিও।”
“জ্ঞান অন্বেষণ (অর্জন) করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।”
“জ্ঞান অন্বেষণ করা অতীত পাপের প্রায়শ্চিত্ত (কাফফারা)।”
“তোমার স্ত্রীর সেবা করা এক ধরনের দান (সাদকা)।”
“আমি কি তোমাকে স্বর্গের রাজাদের একজনের কথা বলব? সে একজন দুর্বল, নিপীড়িত এবং দরিদ্র পোশাক পরিহিত ব্যক্তি যার দিকে কেউ মনোযোগ দেয় না; কিন্তু তার শপথ সত্য হয় যখন সে কিছু ঘটবে বলে আল্লাহর নামে শপথ করে।”
“আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের খবর দেব? তারা অহংকারী, স্বার্থপর, উদ্ধত, লোভী এবং কৃপণ মানুষ।
“আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে সহজ ইবাদত সম্পর্কে অবহিত করব? – (তা হলো) নীরবতা এবং ভাল আচরণ (স্বভাব)।”
“আমি কি তোমাদের সেই লোকদের সম্পর্কে অবহিত করব, যাদের জন্য আগামীকাল জাহান্নাম হারাম করা হবে? (তারা) নম্র, কোমল মনের এবং সহজ-সরল মানুষ এবং যারা মানুষকে ভালোবাসে।”
“আমি কি তোমাকে এমন কিছু গুণবলী সম্পর্কে শিক্ষা দেব যা দিয়ে আল্লাহ তোমাকে লাভবান করবেন? জ্ঞান অর্জন কর কারণ এটি মুমিনের বন্ধু, সহনশীলতা তার পরামর্শদাতা, প্রজ্ঞা তার পথপ্রদর্শক, কর্ম তার অভিভাবক, মধ্যপন্হা তার পিতা, নম্রতা তার ভাই এবং ধৈর্য তার সেনাবাহিনীর সেনাপতি।”
“আমি কি তোমাদেরকে রোজা, নামাজ ও দান-খয়রাতের চেয়ে উত্তম কি তা জানাবো? সেটি হলো মানুষের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানো, কারণ তাদের মধ্যে বিবাদের ফল হলো ধ্বংস।”
বইটির প্রকাশক: রেডিয়েন্ট পাবলিকেশন্স বাংলাদেশ, জিন্নাহ নগর, সপুরা, রাজশাহী।
গ্রন্হস্বত্ব: অনুবাদ কর্তৃক সংরক্ষিত।
মোঃ তুরাব রসুল
রাজশাহী
২৯/৩/২০২৪ ইং
Reviews
There are no reviews yet.