হযরত যয়নাব বিনতে আলী (রা.) [ইসলামের পুনর্জীবন দানকারিণী]

Original price was: ৳ 280.00.Current price is: ৳ 190.00.

Title হযরত যয়নাব বিনতে আলী (রা.) [ইসলামের পুনর্জীবন দানকারিণী]
Author
Translator
Editor
Publisher
Edition 1st Published, 2014
Number of Pages 199
Country বাংলাদেশ
Language বাংলা

সূচিপত্র
* প্রকাশকের কথা
* ভূমিকা
* অধ্যায়-১ : হযরত যয়নাবের জীবন
* অধ্যায়-২ : চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
* অধ্যায়-৩ : জ্ঞানের ধারণক্ষমতা
* অধ্যায়-৪ : হাদিসের আলোকে হযরত যয়নাব
* অধ্যায়-৫ : বিবাহ
* অধ্যায়-৬ : বেদনাদায়ক ঘটনাবলি
* অধ্যায়-৭ : তিন খলিফার শাসনামল
* অধ্যায়-৮ : খলিফা আলীর শাসনামল
* অধ্যায়- ৯ : খলিফা হাসানের শাসনামল
* অধ্যায়-১০ : মুয়াবিয়ার শাসনামল
* অধ্যায়-১১ : জাহেলি দুঃশাসনের প্রত্যাবর্তন
* অধ্যায়-১২ : ঐতিহাসিক কারবালা
* অধ্যায়-১৩ : আশুরার দিন
* অধ্যায়-১৪ : রাসূল (সা.)-এর বন্দিপরিবার
* অধ্যায়-১৫ : মদিনায় প্রত্যাবর্তন
* অধ্যায়-১৬ : পরলোকগমণ

প্রকাশকের কথা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিনের যিনি আদম সত্বাকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারি করেছেন। দুরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তির পথ নির্দেশক রাসুলে পাক (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি।
আজকের বিশ্বের সকল প্রকার বিরোধ ও বিদ্বেষের মাঝে মনুষ্যত্বের অভাব ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হয়। বিরোধের অদম্য নেশা মানুষকে ধীরে ধীরে করে দিচ্ছে পিশাচ সদৃশ। নিদারুণ ও নির্মমতার অন্ধকার কালো থেকে অসহ্য কালোতে পরিণত হচ্ছে। সারা বিশ্বের মিডিয়াতে যদিও এসবের খুব সামান্যই প্রকাশিত হয়, তবুও যেটুকু আমাদের নজরে আসছে, তা রীতিমতো গা শিউরে দেয়ার মতো। এখন পর্যন্ত যতটুকু এসেছে বা আসছে, সেগুলোর সিংহভাগ একটি জাতির (তথা মুসলিম বিশ্বের) চিত্র তুলে ধরলেও বিশ্বের বাকি অংশের অবস্থা যে এর চাইতে উত্তম তা কিন্তু নয়। অপরাধ পরিবারের সীমানা থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মিলিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে এর বিস্তার এখনও হয়তো পুরোপুরি সকলের কাছে প্রকাশিত হয়নি; তবে পশ্চিমা বিরোধীদের কাছ থেকে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তা একেবারেই কম নয়। অর্থাৎ সর্ব দিক থেকে মানবিকতার চরম অবনতি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই এখন দ্রোহের দাবানলকে জাগিয়ে তুলছে। যে কোন সময় ঘটবে বিস্ফোরণ, যার মধ্য দিয়েই একদিন মুক্তির সোনালী সুদিনের সূর্য হাসবে।

মানবতার মুক্তি সংগ্রামে যতগুলো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে তন্মধ্যে কারবালাই একমাত্র যার সাথে আর কোন ঘটনার তুলনা করা সম্ভব নয়। কারবালা মানুষের মুক্তির যে আহ্বান সৃষ্টি করেছে তার মূলমন্ত্র ছিল, “পরাধীন জীবনের চাইতে স্বাধীন মৃত্যু উত্তম। শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার চাইতে স্বাধীন মৃত্যুই হওয়া উচিত মানুষের একমাত্র কামনা।” এই কথার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, মৌলিক সাক্ষী হচ্ছে কারবালায় ইমাম হুসাইনের শাহাদাত। তাই জুলুমে পূর্ণ আজকের বিশ্বে কারবালার গুরুত্বকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। সাম্রাজ্যবাদের নির্দয় শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে কারবালার ঘটনাকে বিবেচনায় রেখে এগিয়ে যাওয়া ব্যতীত বিশ্ববাসির নিকট আর কোন পথ খোলা নেই। ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীরা সেদিন মুক্তির যে অনবদ্য কাব্য রচনা করেছিলেন, তার আহ্বান শাশ্বত, চির অবদান।

আজকের মুসলিম বিশ্বের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে সংকটাপন্ন অবস্থা বিরাজমান তার জন্য যে বিষয়টি সর্বাধিক দায়ী তা হল, মুসলমানদের জন্য সঠিক আদর্শের শূন্যতা। সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে মুসলিম সমাজে নানান রূপে পথভ্রষ্টতার অনুপ্রবেশ করেছে। অর্থাৎ সামাজিক অবস্থা যেমন তাদের বাধ্য করছে অনৈতিকতার দিকে ধাবিত হতে, তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন টেনে নিয়ে যাচ্ছে নির্লজ্জতার অন্ধকারে। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করছে বিশৃঙ্খলতা। ফলে হানাহানি, হত্যা, সহিংসতার মতো ভয়ংকর ব্যধি দ্রুত বাসা বাঁধছে। ধর্মের পোশাকে মুসলিম সমাজে অধর্মের প্রচলন হচ্ছে। সার্বিক দিক থেকে মুসলমানেরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিজাতীয়দের দাসে পরিণত হচ্ছে। এমন সময় মুসলমানদের যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। বহির্বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদেরকে সমুন্নত করে রাখতে হলে সার্বিক উন্নয়ন ব্যতীত উম্মাহর সামনে অন্য কোন পথ খোলা নেই। এই চরম সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে মুসলিম জাতিকে হতে হবে ধৈর্য্যশীল, পরস্পরের প্রতি সহনশীল।

উম্মাহকে এর কেন্দ্র থেকে শক্তিশালী করা না গেলে এই পর্যায়ে উন্নীত হওয়া কোন জাতির পক্ষে সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে সেই কেন্দ্রটি হচ্ছে সমাজের নারী মহল। যারা সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে পর্দার অন্তরালের ভূমিকা পালন করে থাকেন। কারণ এই নারী একই সাথে সমাজে নানামুখি তৎপরতার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। যাদের ভূমিকা কখনও মা, কখনও বোন, কখনও স্ত্রী বা কখনও কন্যা। যাদের ছায়াতলে থেকে সমাজ শৈশব পেরিয়ে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করে। অর্থাৎ সমাজের মৌলিক গঠন সেই পাঠশালা থেকেই সম্পন্ন হয়ে থাকে, যা সাধারণত নজরে আসে না। এমতাবস্থায় যদি নারীদের শক্তিশালী করা সম্ভব না হয়, তাহলে এই পরিস্থিতি আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। অপরদিকে নারী মুক্তির শ্লোগান দিয়ে যারা সমাজে নারীকে শক্তিশালী করার নামে পণ্যের ন্যায় প্রদর্শন করে থাকে, তারা এই সুযোগে অশ্লীলতার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে পুরো সমাজ। যার প্রতিষোধক কারো জানা নেই। অথচ আমাদের নেতৃবৃন্দ এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। নারী আন্দোলনের মৌলিক সমস্যার প্রতি সচেতন না করে, তারাও নানান উপায়ে নারীদের ব্যবহারের চেষ্টায় লিপ্ত। ভ- পীরের দরবার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ইসলামী আন্দোলনে পর্যন্ত নারীদের যথেচ্ছ ব্যবহার এখন অহরহ ঘটনা। সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে (সিরিয়ার যৌন জিহাদ) দৃষ্টি দিলে এর প্রমাণ সহজেই মিলে যায়। তাই মুসলিম নারীদের এই হীন অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হলে তাদেরকে আত্মবলে বলীয়ান হতে হবে। আর এ জন্য নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে অভ্যন্তরিণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকেই। অপরদিকে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে। নারীদেরকে পণ্যের ন্যায় ব্যবহার থেকে ফিরিয়ে এনে স্বকীয় মর্যাদায় উপনীত করতে হবে। তবেই নারীরা সমাজ বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। আর যখন নারীরা এই ভূমিকায় উপনীত হবে, তখন সমাজ সার্বিকভাবে শক্তিশালী হবে। এ লক্ষ্যে নারীদের সামনে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বদের উদাহরণ তুলে ধরতে হবে। তাদের জানতে হবে যে, মুসলিম উম্মাহর নারী সমাজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই ভূমিকায় যেমন সুমহান ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিল, তেমনি নিন্দনীয় ভূমিকারও কোন কমতি ছিল না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, নিজেদের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সেই সকল মহিমান্বিত নারীদের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করা। সেই সকল নারীদের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরে আদর্শের অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে, যাঁরা মানুষের মুক্তির জন্য নিদারুণ কষ্ট ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন। যাঁরা নিজেদের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়েছেন, নিজে অভূক্ত থেকেছেন ক্ষুধার্তকে খাবার দেয়ার জন্য, দরিদ্র সহায়হীন ব্যক্তিদের সাহায্যে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের শেষ সম্বল। ইসলামের সুরক্ষায় তাঁদের অনেকেই বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পুরো জীবনের উপার্জন, সয়েছেন নিদারুণ শারীরিক যন্ত্রণা, সন্তান হারানোর বেদনাকে আড়াল করে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বানে। ক্ষণস্থায়ী জীবনের বিলাসিতাকে পরিহার করে, অনন্ত জীবনের সাফল্যকে নিজেদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করেছেন। এমন কিছু নারীকে আজকে সমাজের সামনে তুলে আনতে হবে, যারা নিজেদের খোদার রঙে রঙিন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যাদের বর্ণালী জীবনে রয়েছে মুসলিম নারীদের জন্য সকল প্রকার শিক্ষা, যা থেকে নারীদের দূরে সরিয়ে রাখার ফলেই সমাজে তৈরি হয়েছে এমন যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা। রাসূল (সা.) তাঁর তেইশ বছরের সংগ্রামী জীবনে নারীদের অধিকারের প্রতি যে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন তা থেকে সরে আসার ফলাফল হচ্ছে নারীদের আজকের অবস্থান। নারীরা এখন কোথাও সম্মানিত নয়। পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনেও তাদের রয়েছে নানান ভোগান্তি। লালসার হীন আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার অন্যতম লক্ষ্য যেন নারী। বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন মুসলিম সমাজে এমনভাবে শিকড় গেড়েছে যে, এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। সমাজের মধ্যে যৌনতার নানান সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একেবারে শিশু অবস্থা থেকেই এখন সমাজে যৌনতার প্রশিক্ষণ চলছে অদম্য গতিতে, যা পরিবারের সবাইকে নিয়েই উপভোগ্য। পরিবারের সকল স্তরের সদস্যদের দৃষ্টিতে এখন প্রদর্শিত এসকল যৌন আহ্বান একেবারে মামুলি বিষয়। ফলে পরিবারে ও সমাজে ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত সকল দুর্ঘটনা। যেখানে পিতা-মাতা সন্তানকে সভ্যতার শিক্ষা দিবেন, সেখানে সকলে একসাথে এসকল অসভ্য চর্চা করে যাচ্ছেন কোন প্রকার অস্বস্তি ব্যতীতই। শিক্ষা ব্যবস্থায় খুবই কৌশলে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে এসকল নির্লজ্জতা। স্বাস্থ্য সচেতনতার নামে সুক্ষ্ণভাবে যৌনতার প্রাথমিক তথ্যগুলো কোমলমতি কিশোর-কিশোরীদের পাঠ্যবইয়ে সংযোজন করা হয়েছে, যার আশু পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

তাই এসকল বিজাতীয় কাল্পনিক চরিত্রের করাল গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে এমন কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে, যাদের আকর্ষণ অত্যন্ত শক্তিশালী। নারীদের সামনে প্রকাশ করতে হবে যে, এসকল নির্লজ্জ চরিত্রের পরিবর্তে তাদের জন্য এমন সব গৌরবময় চরিত্র বিদ্যমান যা সকল দৃষ্টিকে বিনম্র করবে এবং তাদেরকে সকলের দৃষ্টিতে করবে সম্মানিত, যাদের অনুসরণে তারা ফিরে পাবে সমাজে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা এবং জাতি গঠনে নিশ্চিত করবে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান। নারীদের সামনে এসকল ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর বর্ণাঢ্য জীবনের বিস্তর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে এই কথাই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে, একমাত্র সভ্যতার লালনেই একটি জনগোষ্ঠীকে শক্তিশালী করা সম্ভব। আর এজন্য প্রয়োজন সঠিক ও পঙ্কিলতা মুক্ত আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। যার একমাত্র উদাহরণ হচ্ছেন খোদ রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত, যাদের অক্লান্ত ত্যাগ, নিঃস্বার্থ পরিশ্রম ও অনন্তকর প্রয়াসের কল্যাণে হেদায়েতের আলোক রশ্মি আজও পৃথিবীর বুকে প্রজ্বলিত। এই সকল সুমহান আদর্শকে সমাজের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েই সম্ভব একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি গঠন করা।

হযরত যয়নাব বিনতে আলী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন, যিনি সকল মানবিক গুণে স্বকীয় মর্যাদার অধিকারী। অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে যত জন নারীর নাম দুনিয়া জুড়ে স্মরণীয় তাঁদের শীর্ষস্থান তাঁকেই মানায়, যিনি জ্ঞানে ছিলেন সৃষ্টিশীল, সততায় ছিলেন অনুপম, সচ্চরিত্রে ছিলেন ঈর্ষনীয়, আর ত্যাগের ক্ষেত্রে ছিলেন অনতিক্রম্য। যয়নাব বিনতে আলী ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যার পবিত্র আকর্ষণ কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের মাঝে সভ্যতার আলো প্রজ্বলিত রাখবে। যিনি তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে নারীদের স্বীয় মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পন্থা চিহ্নিত করেছেন। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে স্বাধীনচেতা হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে হয়, মুক্তির সংগ্রামে কিভাবে পুরুষের পাশাপাশি অনন্য অবদান রাখতে হয়।

যয়নাব বিনতে আলী ছিলেন কারবালার অন্যতম সাক্ষী, যিনি কাছ থেকে কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছেন। কারবালার এবং এর পরের সময়গুলোতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। কারবালার ইতিহাসের সিংহভাগ তাঁর থেকেই বর্ণিত। কারবালার দুর্ঘটনার পর তিনি যেভাবে আহলে বাইতের অবশিষ্ট সদস্যদের আগলে রেখেছিলেন, ঠিক সমপরিমাণ মমতায় তিনি এই ইতিহাস বয়ে নিয়ে গেছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। যদিও কারবালার পর থেকেই তিনি মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন অসুস্থ, কারণ কারবালার অসহনীয় দৃশ্য তাঁকে কখনোই স্থির থাকতে দেয়নি। প্রতিনিয়তই সেই নির্মম বেদনাদায়ক দৃশ্যগুলো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াতো, যা থেকে তিনি কখনোই মুক্তি পাননি। তাঁর সকল কথা, কর্ম, বক্তব্য, নসিহত, উপদেশ, নির্দেশ সকল কিছুই ছিল কারবালার সংগ্রামী ইতিহাসের প্রতি আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে। ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর অনন্তকর প্রচেষ্টা ছিল কারবালার সংগ্রামী দিককে মানুষের সামনে স্পষ্ট করা, যার দ্বারা মানুষ স্বাধীনতার ভীত রচনা করতে সক্ষম হবে। এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য যেমন ছিল স্পষ্ট, তেমনি ক্ষুরধার। সকল স্থানেই তিনি সেই ঘটনায় বনু উমাইয়্যাকে তীব্র অপরাধ বোধের বেড়াজালে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের দরবার থেকে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের দরবার পর্যন্ত যতগুলো স্থানে তিনি কথা বলেছেন, সকল স্থানেই তিনি ইমাম হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবু তালিবকে বিজয়ী হিসেবে প্রমাণ করেছেন এবং বনু উমাইয়্যাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্ষমার অযোগ্য জালিম হিসেবে। বহু দরবারী ঐতিহাসিক, যারা রাজা বাদশাহদের উপঢৌকনে লালায়িত হয়ে ইতিহাসে জালিমদের সুবিধা মতো মিথ্যা ইতিহাস অনুপ্রবেশ করিয়েছে, তাদের মোক্ষম জবাব হচ্ছেন স্বয়ং যয়নাব বিনতে আলী। তিনি নিজেই এক ইতিহাস যার মধ্যে সকল বিভ্রান্তির জবাব পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক এ সকল বিভ্রান্তি আরব থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলেই প্রবেশ করেছে। কোন সন্দেহ নেই, এই সকল ইতিহাস রচনার মধ্য দিয়ে কারবালার মৌলিক উদ্দেশ্যকে মানুষের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। তাদের এসকল মিথ্যাচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ইমাম হুসাইনের সুমহান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, যাতে মানুষ কখনও তীব্র প্রতিবাদী হওয়ার উৎসাহ না পায়। যাতে জালিমের নিষ্পেষণের কাছে জনগণকে মাথানত রেখে নিজেদের আখের গোছানো সম্ভব হয়।

যদিও তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি, তবুও তারা সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহের বীজ বুনতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে আজকে মুসলিম বিশ্বে ইমাম হুসাইন ও তাঁর অবিস্মরণীয় সংগ্রাম সম্পর্কে মানুষের মনে নানান ধরণের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য শুনতে পাওয়া যায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বর্তমান যুগের ওয়াহাবি, সালাফি, তাকফিরি, আহলে হাদীসদের মিথ্যাচার। তারা তাদের লেখনী, বক্তব্য, ওয়াজ মাহফিলের দ্বারা কারবালা সম্পর্কে নানান ধরণের মিথ্যা বানোয়াট ঘটনা জুড়ে দিয়ে এটিকে মানুষের দৃষ্টিতে অন্ধকারাচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। তারা হয়তো বুঝতে পারছে না, তাদের এই কাজ একদিন তাদের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করবে। কারণ কারবালাকে মানুষের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে, মানুষকে মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত রাখা। কারবালাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার আরেক নাম হচ্ছে, সংগ্রামের গৌরবে উজ্জীবিত জনতার প্রতিবাদকে মুছে দেয়া। কারবালাকে আড়াল করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে, জালিমের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তিকে মুছে দেয়া।

বাজারে যেসকল বই কারবালার বিরুদ্ধে রেফারেন্স হিসেবে তুলে আনা হচ্ছে, সেগুলো কোন অবস্থাতেই কারবালার সঠিক ইতিহাস মানুষের সামনে প্রকাশ করেনি। কেন ইমাম হুসাইন প্রতিবাদী হয়েছিলেন, কিভাবে তিনি এই সংগ্রামের পন্থা রচনা করেছিলেন, কিভাবে তিনি এই অনবদ্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন এর উত্তর না জানলে কোন ভাবেই মানুষের পক্ষে এর থেকে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়।

বাংলা ভাষায় কারবালা সংক্রান্ত একটি বইকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে নানান বিভ্রান্তি বিদ্যমান। মীর মোশাররফ হোসেনের রচিত “বিষাদ সিন্ধু” এখন পর্যন্ত মানুষের কাছে কারবালার ইতিহাস হিসেবে সুপরিচিত, যেখানে কারবালার প্রেক্ষাপট, প্রয়োজন, গুরুত্ব, মূল ইতিহাস, পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই। একজন লেখক, তাঁর রচনা শৈলী দ্বারা একটি ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস রচনা করেছেন, সেখানে প্রতিটি পরতে পরতে আছে মিথ্যা ও মনগড়া তথ্য। ব্যক্তিদের পরিচয় থেকে শুরু করে স্থান, ঘটনা কোন কিছুর সাথেই প্রকৃত ইতিহাসের বিন্দুমাত্র মিল নেই। শুধুমাত্র কারবালার বেদনাদায়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি আকর্ষণীয় উপন্যাস রচনা করা হয়েছিল, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়া, যা লেখক ভালোভাবেই পেয়েছেন। করুণ কাহিনী এতে তুলে ধরার কারণে ইতিহাস সম্পর্কে কোমলমতি বাংলার মুসলিম সমাজ সেখানেই খুঁজে নিয়েছেন কারবালায় ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার দৃশ্যগুলো। এই উপন্যাসের লেখক না কোন ঐতিহাসিক আর না কোন আলেম। অথচ তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছেন, যার রয়েছে অসাধারণ প্রকাশভঙ্গী যা মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখায়। তিনি এমন বিষয়টিকে নানান ধরণের বানোয়াট গল্পের দ্বারা সাজিয়েছে, যার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস তৈরির অনন্য ক্ষমতা, যেখান থেকে তৈরি হয়েছে হাজারো বিপ্লবের পথ। অথচ এই লেখক সেগুলোর কোন দিকেই পদচারণা না করে কেবল একটি উপন্যাসের অবতারণা করেছেন, যা ছিল কারবালার মূল উদ্দেশ্যকে মানুষের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার অপপ্রয়াস।

অথচ কারবালার ঘটনায় এমন কিছু চরিত্রের উপস্থিতি উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়, যেগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত না করলে কারবালার মৌলিক দিক সম্পর্কেই অজানা থেকে যায়। কারবালার দৃশ্যপটে উজ্জীবিত এই আলোকরশ্মিরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে আগামীদিনের মানুষদের জন্য এই বার্তা রেখে গিয়েছেন যে, “আমরা তোমাদের সংগ্রামের পথ দেখিয়ে দিয়েছি, স্বাধীনতা অর্জন হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া তোমাদের কাজ।” সেদিনের সেই আত্মাহুতির ঘটনাটি ছিল মানবতার মৌলিক চাহিদার বার্তা শুনানোর আয়োজন। যে আয়োজনে ইমাম হুসাইন ছিলেন মূল ব্যক্তিত্ব, যাকে ঘিরে দ্বিধাহীন কিছু ব্যক্তি নিজেদের নিঃশেষ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এই বিসর্জন শুধু কারবালার শহীদেরাই দেয়নি। দিয়েছেন শহীদদের রেখে যাওয়া পরিজনেরাও, যারা তৎপরবর্তী সময়ে নিদারুণ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের কেউ বৃদ্ধ বয়সের আশ্রয়, কেউ বাবার স্নেহ, ভাইয়ের আদর, প্রিয়তমার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছিলেন। কেউ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যয়নাব বিনতে আলী যিনি সেদিন হারিয়েছিলেন ভাইদের, ভাইপোদের, সন্তানদের। এমনকি নবী পরিবারের নারীরাও সেদিন হারিয়েছিলেন নিজেদের মাথার চাদর, যা দ্বারা তারা নিজেদের আড়াল করে রাখতেন অসভ্যতার কুদৃষ্টি থেকে।

কেমন ছিল তাঁদের সেই দিনগুলো, যখন না সান্ত¡না দেয়ার কেউ ছিল আর না ছিল নতুন করে আশা জাগানোর কেউ? যাদের না আশ্রয় ছিল, আর না ছিল পালানোর কোন পথ? যাদের প্রদর্শনীর জন্য বাজারে ঘুরানো হয়েছিলো, অথচ তাদের দিকে মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর কেউ ছিল না। হ্যাঁ, মাত্র ৫০ বছর পার না হতেই এমনই এক নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিলো ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা রাসূল (সা.)-এর পরিবার-পরিজনের, যাঁদের সেদিন আগলে রেখেছিলেন যয়নাব বিনতে আলী। যিনি ছিলেন অসহনীয় ক্লান্ত, ব্যাথ্যার তীব্রতায় ছিলেন মুষড়ে পড়া। অথচ দায়িত্বের পরিপূর্ণ জ্ঞান তখনও ছিল। তখনও ছিল ক্ষোভ প্রকাশের দূরন্ত সাহস, যার সামনে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের মতো প্রতাপশালী জালিমেরা স্থির থাকতে পারেনি, নিদ্রাহীন হতে হয়েছিলো ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানকেও। একই সাথে তিনি প্রচার করেছেন কারবালার বার্তা, একই সাথে শিখিয়েছেন বেঁচে থাকার সংগ্রামে কিভাবে আত্মনিয়োগ করতে হয়, কিভাবে বিজয়ের সোনালী সূর্য ছিনিয়ে আনতে হয়।

তাই, আজকের যুগের নারীদের জন্য যয়নাব বিনতে আলীর আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ ব্যতীত আর কোন পথ খোলা নেই। নিজেদের অধিকার ও মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সচেতন নারীদের অবশ্যই ফিরে আসতে হবে তাঁর দিকে, যিনি সাহসিকতার অতুলনীয় উদাহরণ। যিনি জালিমের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদী হতে শিখিয়েছেন। যিনি শিখিয়েছেন যেখানে মুক্তির আশা ক্ষীণ হয়ে আসে সেখানে প্রতিবাদের ভাষা হতে হয় তীক্ষ্ণ। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই মহীয়সী নারী সবাইকে দেখিয়েছেন, যেখানে মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকার সম্ভাবনা থাকে না সেখানে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার হওয়াই মর্যাদার নিশানা। আর তাই বর্তমান সমাজে নারীদের আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হতে হলে তাঁর আদর্শের তলে সমবেত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আমাদের সমাজে অবরুদ্ধ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে তাঁর দিকেই ধাবিত করতে হবে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সমাজে সেই সকল নারীদের অবস্থান বৃদ্ধি করুন, যারা আগামীর ভীত রচনায় অবদান রাখতে পারবে। যারা পারবে যয়নাব বিনতে আলির মতো সব হারিয়েও আশায় বুক বাঁধা এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মুসলিম নারীরা যয়নাবের মতো প্রতিবাদী হবে এবং সমাজকে আহলে বাইতের প্রেমিক তৈরির বাগানে পরিণত করবে, ইনশাল্লাহ্।
– প্রকাশক

অনুবাদকের কথা
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের, যিনি সৃষ্টিজগতকে তাঁর অসীম করুণা দ্বারা আবৃত করে রেখেছেন। দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি যাঁরা দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ত্যাগের মহিমায় উজ্বল হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। সবিনীত সালাম কায়েম-উয-যামানের প্রতি, যাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রজ্বলিত রেখেছেন তাঁর নূরকে।

যুগে যুগে ইসলামের পুনর্জাগরণে কিছু ব্যক্তির অবদান এত গৌরবময় যা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা সত্যিই তাঁর প্রতি জুলুম করার শামিল। এ সকল মহীয়ান গরিয়ান ব্যক্তিবর্গ নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে মুসলিমসমাজে ইসলামের প্রদীপ প্রজ্বলিত করে রেখেছিলেন। তাঁদের এই অবদান কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় ও ইতিহাস যাঁদের কর্মের মধ্যে নিহিত, তাঁদের বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা আর ইসলামের মৌলিক ভিত্তির প্রতি নির্লিপ্ত থাকা একই কথা। যখন কোনো জাতি তাঁদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে না, তখন সেই জাতি আত্মপরিচয়ে বলিয়ান হতে পারে না। আর যে জাতির আত্মপরিচয় থাকে না, সে জাতি পৃথিবীর বুকে কখনও গৌরবের শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। লাঞ্ছনা এবং বঞ্চনা তখন সেই জাতির ললাটে ভাগ্যের লিখনে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে তারা নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলার কারণে অভ্যন্তরীণভাবে হয়ে পড়ে শক্তিহীন।

এমন দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠছে মুসলিম জাতি। যাদের উত্থানের মৌলিক কারণ ছিল হার না মানা আদর্শ, তারা এখন বিশ্বের বুকে অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। এক সময় যেখানে কায়সার ও কিসরা মুসলিম জাতির হুঙ্কারে তটস্থ থাকত, সেখানে এখন খোদ মুসলমানেরাই পশ্চিমাবিশ্বের দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রতি নির্ভরশীল। আর এই সুযোগে পশ্চিমাবিশ্ব মুসলমানদের মাথার উপর দুঃশাসনের ছড়ি ঘুরাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের বলে বলিয়ান মুসলিমজাতির চোখে রঙিন চশমা পড়িয়ে বিভোর করে রাখা হয়েছে। আর এই ঘৃণ্য কাজে সহযোগিতা করছে মেরুদ-হীন এক দল স্বার্থান্বেষী নেতা, যারা মুসলমানদের রক্তের বিনিময়ে অবলীলায় ক্রয় করছে মাদকতা, বেহায়াপনা। শিক্ষাব্যবস্থাকে তাদের আদতে সজ্জিত করে জাতিকে করা হয়েছে শক্তিহীন। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বলয় পর্যন্ত মুসলমানরা এখন পুরোপুরি পশ্চিমানির্ভর। ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে মসজিদের সীমানায় বেঁধে রেখে সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বেহায়াপনার কালো থাবা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সজ্জিত হচ্ছে নির্লজ্জতার পোশাকে।

সুতরাং এই হীন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো নিজেদের পরিশুদ্ধ করা। এ জন্য এমন কিছু আদর্শ আমাদের সামনে থাকতে হবে, যাদের ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহ করা যায় না। নিজেদের মৌলিকত্বকে সুদৃঢ় করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তাদের কাছে, যারা কখনো মানুষকে বিভ্রান্ত করেন না। নিজেদের মধ্যকার অজ্ঞতা, অপূর্ণতাকে ছুড়ে ফেলতে হলে তাদের পথেই হাঁটতে হবে, যারা সত্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত। যাদেরকে দেয়া হয়েছে হেদায়েতের আলোর মশাল। রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইত-ই একমাত্র সেই পথ, যা আল কোরআন এবং রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে ইসলামের পতাকা আহলে বাইতের হাতেই উড্ডীন হয়েছিল। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কারবালা, যেখানে মানবতার মুক্তির সনদ রয়েছে। কারবালা এমন এক ইতিহাস, যেখানে শিখানো হয়েছে স্বাধীনতার চেয়ে আর বড় কোনো সম্মান মানুষের জন্য হতে পারে না। যখন ইমাম হুসাইন দেখলেন যে, এখন আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয় তখন মুসলিম উম্মাহর বিবেকের দরজায় কুঠারাঘাত করলেন। দেখলেন এত দিনে উম্মাহ নিস্তেজ হয়ে গেছে। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে জনগণ নির্লিপ্ত কিছু মানুষের সমাজে পরিণত হয়েছে। তিনি বুঝলেন এখন আর এ জাতির জন্য নসিহত কোনো কাজে আসবে না। তাই তিনি এমন এক পন্থা অবলম্বন করলেন, যা সবাইকে চমকে দিয়েছিল। তিনি নিজেকে এমনভাবে উৎসর্গ করলেন যে, মানুষ আর চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারেনি। সরব হতে বাধ্য হলো।

সেই জাগরণ আজও অব্যাহত রয়েছে। সংগ্রামের সেই আহ্বান মানুষকে এমন ভাবে উজ্জিবিত করেছিল যে, আজও প্রতিটি প্রতিবাদি কণ্ঠে যেন কারবালার প্রতিধ্বনি শুনা যায়। কারবালা শুধু মুসলমানের গৌরবে পরিণত হয়নি, কারবালা হয়ে উঠেছে সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী জনতার সংগ্রামের প্রতীক। আর এই কারবালাকে যে কয়জন ব্যক্তিত্ব বিশ্বের বুকে বৈপ্লবিক রূপ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন আমিরুল মুমিনিনের কন্যা যয়নাব বিনতে আলী। যিনি ছিলেন কারবালার ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কারবালার প্রতিটি ক্ষণ তিনি কাছ থেকে অবলোকন করেছেন। নিজ সন্তানদের শাহাদত থেকে শুরু করে রাসূল (সা.)-এর পরিবারের সদস্যদের ও আহলে বাইতের অনুসারীদের অতুলনীয় আত্মত্যাগের মহান বাণী তিনি বয়ে নিয়ে গেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। যেখানেই তিনি পদচারণা করেছেন, সেখানেই তাঁর একমাত্র বক্তব্য ছিল কারবালাকেন্দ্রিক।

এই মহীয়সী নারীর জীবনকালে এমন সব ঘটনার অবতারণা হয়েছিল, যেগুলো ইতিহাসের পট পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি তাঁর জীবনচরিতে রয়েছে মুসলিম নারীদের জন্য অতুলনীয় আদর্শ। মা-ফাতিমার শাহাদতের পর মুসলিম-সমাজের নারীদের জন্য দ্বীনের শিক্ষা অর্জনে হযরত যয়নাব বিনতে আলী ছিলেন অতুলনীয়। তিনি এমন এক অনুকরণীয় পন্থা দেখিয়ে গেছেন, যা এড়িয়ে গেলে মুসলিম-নারীদের জন্য আদর্শের আর কোনো মাপকাঠি গ্রহণযোগ্য থাকে না।

আজকের মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নির্লজ্জতার যে সয়লাব শুরু হয়েছে, তা রোধ করতে হলে নারীদের জন্য এ আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। আজকের দিনে মিডিয়া এবং নানা ধরণের অপপ্রচারে যেখানে নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে নারীদের বিন্দুমাত্র সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয় না, নারীস্বাধীনতার নামে যেখানে নারীদের বেপর্দা করা হচ্ছে -এর প্রতিরোধ করতে হলে নারীদের এই সকল মহীয়সীর আদর্শের দিকে ধাবিত হওয়া ব্যতীত আর কোনো পথ খোলা নেই।

মনে রাখতে হবে, জাহেলিয়াতের ভয়াল থাবা থেকে নারীদের রক্ষা করা না গেলে জাতিসত্তার কোনো অস্তিত্ব ধরে রাখা যাবে না। কারণ নারী হচ্ছে বংশের আমানতদার। সমাজে শত শত পুরুষ নষ্ট হয়ে গেলেও সমস্যা ততটা প্রকট আকার ধারণ করে না, যতটা প্রকট হয় একজন নারী নষ্ট হয়ে গেলে।

তাই নারীদের এমন আদর্শের অবকাঠামোতে প্রস্তুত হতে হবে, যা তাদের সম্মানের উচ্চ পর্যায়ে উত্তীর্ণ করবে। “যয়নাব বিনতে আলী (রা.)” এমনই একজন আদর্শ। তিনি এমন এক মায়ের সন্তান যিনি জান্নাতি নারীদের নেত্রী। এমন পিতার ঔরস থেকে পৃথিবীতে এসেছেন, যিনি দ্বীনের মৌলিক ভিত্তি।

আমাদের এই ক্ষুদ্র বইটি হযরত যয়নাব বিনতে আলীর জীবনের সকল দিক সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য যেমন প্রয়োজন আরও অধিক গবেষণা, তেমনি প্রয়োজন একদল নিষ্ঠাবান গবেষকের, যাঁরা মুসলিম নারীদের জন্য এমন ব্যক্তিত্বদের জীবন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করবেন। আমাদের এই প্রচেষ্টা একটি সুদীর্ঘ পথের যাত্রার প্রথম ধাপ, যা থেকে তৈরি হবে শত শত যাত্রী। ইনশাআল্লাহ একদিন এই পথ ধরেই আগামী দিনের সোনালি সূর্যের প্রত্যাশা করবে এই জাতি। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই পথে পরিচালিত করুন। আমিন
-অনুবাদক

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “হযরত যয়নাব বিনতে আলী (রা.) [ইসলামের পুনর্জীবন দানকারিণী]”

Your email address will not be published. Required fields are marked *